বহরমপুর :- চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্রের শেষ দিনে এই পূজার সূচনা হয়। চলে বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিন পর্যন্ত। বারো মাসে তেরো পার্বণের বাংলায় এই পূজা উপলক্ষে রাজ্যের নানা প্রান্তের মানুষ মেতে ওঠেন উৎসবে। চড়ক পূজা উপলক্ষে মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি, বহরমপুর ও জঙ্গিপুর সহ লালবাগে মেলা বসে, আবার জেলার সীমান্ত এলাকাবর্তী গ্রামগুলিতেও এই পুজাকে কেন্দ্র করে ভালোই উদ্দীপনা দেখা যায় ।
তেমনই বড়ঞা, খড়গ্রাম ও সালার সহ বিভিন্ন অঞ্চল গুলি এই চড়ক উৎসবে মেতে ওঠে। জনশ্রুতি আছে ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা এই পূজা প্রথম শুরু করেন। তার পর থেকেই এই পূজা প্রচলিত হয় গ্রামবাংলার সংস্কৃতিতে। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য তথা হুতোমপ্যাঁচার নকশাতেও এই মেলার উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও সেখানেও সমাজের নিচুতলার মানুষের মধ্যেই এই পূজার প্রচলন বেশি দেখা যায়।হিন্দু ধর্মের প্রাচীন রীতিতে এই পূজার অপর নাম নীল পূজা, যা চৈত্র মাসের সংক্রান্তির আগের দিন পালিত হয়। আগের দিন চড়ক গাছটি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। তারপর এক জলভরা পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা পুজারিদের কাছে “বুড়োশিব” নামে পরিচিত”।
এই পূজার বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজো, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়ে হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর দিয়ে লাফানো, বানফোড়া,শিবের বিয়ে,অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানে বারানো বা হাজারা পূজা করা। জেলার বিভিন্ন পূজা কমিটির উদ্যোক্তারা কয়েকজনের দল নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ান। দলে থাকেন একজন শিব ও দুজন সখী। একজনকে সাজানো হয় লম্বা লেজ দিয়ে তাঁর মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফল। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাঁদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসর সহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচেন।এঁদেরকে নীল পাগলের দল বলে ডাকা হয়। এঁরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের নাচ-গান পরিবেশন করেন। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়েই এই চড়কের পূজা হয়।
এই উৎসবকে কেন্দ্র করে জেলার বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা “চড়ক সংক্রান্তির মেলা” নামেও পরিচিত।“ এই সব পূজোর মুলে রয়েছে ভুতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীর পিঠে লোহার হুড়কা বিঁধিয়ে তা চাকার সাথে বেঁধে দ্রুত গতিতে ঘোরানো হয়। তাঁর হাতে,পায়ে, জিভে ও শরীরের অনান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তাঁর গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হয়। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরেও আজ অবধি গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রথা চলে আসছে”। বৃহস্পতিবার বিকেলের পরে সন্ধ্যা থেকেই বহরমপুর শহরের বিভিন্ন জায়গায় চড়ক পুজোর খেলা দেখতে ভিড় জমিয়েছেন শহরবাসী সহ আশে পাশের এলাকার বাসিন্দারাও।