নিজস্ব সংবাদদাতাঃ- একটার পর একটা বৃহৎ জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে স্থায়ী ভবন বাসের জন্য অথবা বিনোদন বা বাণিজ্যের জন্য। শুধু শহরেই নয়, গ্রামাঞ্চলও রেহাই পাচ্ছে না। অথচ আইন আছে সরকারি অনুমোদন ছাড়া যে কোন জলাশয় ভরাট বেআইনী, দণ্ডণীয় অপরাধ। জলাশয় না থাকলে ভূগর্ভস্থ জল মজুতে টান পড়বে(ইতিমধ্যেই ব্যাপকভাবেই তার প্রমাণ মিলছে), বায়ু দূষণ বাড়বে(বিচিত্র ও অজানা রোগের আগমনে তার প্রমাণ মিলছে), উপকারী জলজ প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদ বাঁচবে না, অতিবৃষ্টির জল ধারণ করার ব্যবস্থা ব্যাহত হবে ইত্যাদি। প্রশাসন নিজেই এমন সতর্কতা বারে বারে ঘোষণা করেছে মাইকযোগে, মুদ্রিত প্রচার পত্র বিলি করে। সদ্যঃ অনুষ্ঠিত পুর নির্বাচনে বিভিন্ন দলীয় প্রার্থীই এবিষয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবু পুকুর, বিল হারিয়ে যাচ্ছে এবং প্রশাসন তা বন্ধ করার জন্য কোন কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে না। বিভিন্ন ছোটো ছোটো নদ-নদীতেও জলধা্রা বজা্য থাকছে না যথাযথ সংস্কার হচ্ছে না বলে। গোটা জেলা জুড়েই এই সমস্যা। প্রশাসন নির্বিকার।
২০১৭ সালের জুন মাসে বহরমপুর শিল্পমন্দির উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে এক নাগরিক সমাবেশে তৈরি হয়েছিল জলাভূমি রক্ষা কমি্টি মুর্শিদাবাদ জেলা। তখন চালতি্যা বিল নিয়েই ভাবনা ছিল। এটি পঞ্চায়েত এলাকায় হলেও বহরমপুর শহর সংলগ্ন এবং শহরের দূষিত জল শোধন ছাড়াই এই বিলে পড়ে। ১৯৮৬তে চালু হওয়া গঙ্গা এ্যাকশন প্ল্যানের জেরে নদীর সাথে তার সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাওয়ার অন্য পথ গোবরানালার উপরেও ২০০২-০৩ সাল থেকে বিভিন্ন কারবার ও বসতি গড়ে উঠতে থাকার কারণে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা পুরো বন্ধ হয়ে যায় এবং পার্শ্ববর্তী চাষের জমিকে বিলের অংশ করে তোলে। ৩৫ একরের জলা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে আয়তনে। রায়তেরা ক্ষতিপূরণ পাননি। গোবরানালা খোলা, বিলে মাটি পড়া বন্ধ করা ও নাগরিকদের বর্জ্য জল বিলে ফেলার আগে শোধন করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে জলাভূমি রক্ষা কমি্টি।
পরে আরও প্রায় কুড়িটি পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে ও মজে যাওয়া পুকুরগুলির সংস্কারের দাবিও যোগ হয়। বারে বারে দাবি পেশ করা হয় সরকারের ভূমি দপ্তরে, জেলা শাসক, পুরসভা ও পুলিশের কাছে। সারা দিনের অবস্থান হয়েছে জেলা প্রশাসনিক ভবনের সামনে, মিছিল হয়েছে, পথসভা হয়েছে। অবশেষে কমি্টি গত বছর অক্টোবরে(২৭-২৯) জেলা প্রশাসনিক ভবনের সামনে টানা তিন দিনের অনশন-অবস্থান কর্মসূচি নেয় প্রশাসনিক তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে আশায় এবং যথেষ্ট আগে থানার মাধ্যমে মহকুমা শাসকের(সদর) কাছে লিখিত অনুমোদনও চাওয়া হয় কয়েক দিনের ব্যবধানে দু’বার। থানার ইনস্পেক্টর ইনচার্জের কাছ থেকে ডাক পেয়ে কমি্টির প্রতিনিধিরা তাঁর সঙ্গেও দেখা করে চব্বিশ অক্টবর এবং তাঁরই পরামর্শে পর দিন মহকুমা শাসকের সঙ্গেও দেখা করতে যায়। মহকুমা শাসক প্তভাত চ্যাটার্জী কমি্টিকে সময় দিতে পারেননি। প্রতিনিধিরা দীর্ঘ ক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে আসেন। অস্থায়ী শিবির তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেলে ছাব্বিশ তারিখ সন্ধ্যায় মহকুমা শাসকের সাথে সম্মুখ আলাপচারিতার সুযোগ মেলে। তাঁকে বলা হয়, রাজ্যে জারি থাকা কোভিড বিধি মেনে এই অনশন-অবস্থান হবে, মাইক বাজানো হবে না এবং রাতে দশটার পরে কমি্টির কেউ শিবিরে বা রাস্তায় থাকবেন না। মহকুমা শাসক এক কথা বার বার বলেন, তিনি অনুমোদন দেবেন না। তাঁর এই মত যথেষ্ট আগেই তিনি কমিটিকে জানিয়ে দিতে পারতেন। তাহ’লে কমি্টি তাদের কর্মসূচি নিয়ে অন্য কিছু ভাবনার সুযোগ পেত।
২৭ অক্টবর সকাল থেকেই আন্দোলনকা্রীরা উপস্থিত হতে থাকেন। থানার আই-সি রাজা সরকার নিজ বাহিনী নিয়ে এসে বলেন, অবস্থান সরিয়ে অন্যত্র করতে এবং তাতে তিনি সহযোগিতা করবেন। কমি্টি কিন্তু স্থান বদল বা কর্মসূচির বদল ঘটাতে রাজি হয়নি। এক সময় মহকুমা শাসক শ্রী চ্যাটার্জী এসে জমায়েতকে অবৈধ ঘোষণা করেন, সরকারি জায়গা ছেড়ে চলে যেতে বলেন এবং তারপর পুলিশকে নির্দেশ দেন তাঁর আদেশ অমান্যকারীদের গ্রেপ্তার করতে। ছাব্বিশ জন আন্দোলনকা্রীকে থানায় পুলিশের গাড়িতে চাপিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং ঘন্টা তিনেক পরে ব্যক্তিগত জামিননামায় থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার হওয়া আন্দোলনকা্রীরা হলেন নির্মল সরকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকা(৭৭), অদিতি কুমার ধাওয়া, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক(৮০)বছর, শুক্লা মণ্ডল, অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষিকা ও জলাভূমি রক্ষা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়িকা(৭৪), মুর্তজা হোসেন, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি(৭০), অভিজিৎ সরকার, বাচিক শিল্পী ও নাট্যকর্মী(৬৫), সীমা সরকার, বাচিক শিল্পী(৬৫), তপন সামন্ত, অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক ও প. ব. বিজ্ঞান মঞ্চের জেলা সভাপতি(৬২), কাবেরী বিশ্বাস অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষিকা(৬১), মিলন মালাকার, মানবাধিকার কর্মী(৬৮), দীপক বিশ্বাস, নাট্যকর্মী(৬৫), সাখাওয়াত হোসেন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক(৬০), অজয় অধিকারী, অধ্যক্ষ, জিয়াগঞ্জ কলেজ(৫৬), সজল বিশ্বাস, শিক্ষক ও প.ব. বিজ্ঞান মঞ্চের জেলা সম্পাদক(৫২), দেবজ্যোতি বিশ্বাস, শিক্ষক, সম্পাদক, প্রাক্তনী,কৃষ্ণনাথ কলেজ(৫৩), শিল্পী সেন, প্রধানশিক্ষিকা,জলাভূমি রক্ষা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়িকা(৫৩), সুগত সেন, শিক্ষক ও চিত্রশিল্পী(৫৭), সুমন সেন, শিক্ষক(৪৭), সোনালী গুপ্ত ,শিক্ষিকা(৪৮), শ্রাবণী সাহা, শিক্ষিকা(৪৪), সুবর্ণা নাথ, শিক্ষিকা ও বিজ্ঞান কর্মী(৪২), মনীষা ঘোষ, জলাভূমি রক্ষা কমিটি(৪০), দেবারতি দেব চৌধুরী, সংগীতশিল্পী(৩৫), তৃষা ঘোষ, জলাভূমি রক্ষা কমিটি(৩৫), সৈকত সরকার, জলাভূমি রক্ষা কমিটি(৩২), শৌভিক সাহা, ছাত্র(২০), সুদীপ্ত হালদার, ছাত্র(২০) সেই গ্রেপ্তারের জেরে এই ছাব্বিশ জনের অধিকাংশ গত এক এপ্রিল থানার পিয়নের কাছ থেকে চিঠি পান যে তাঁদের নামে বহরমপুর থানা অভিযোগক্রমে(ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৩ অবৈধ জমায়েতে অংশ গ্রহণ, ১৮৬ সরকারি কর্মচারিদেওর কাজে বাধাদান, ১৮৮ আইন অমান্য এবং বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫২ ক্ষমতাপ্রাপ্ত আধিকারিকের নির্দেশ না মানা) তিন এপ্রিল(রবিবার) জেলা বিচার বিভাগীয় বিচারকের সামনে হাজির হতে হবে। এই অভিযোগের পরি্প্রেক্ষিতে এক বছর কারাদণ্ডও জুটতে পারে। মজার ব্যাপার আদালত থেকে থানাকে সমন পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ২৫-১২-২০২১ তারিখে, অর্থাৎ ছুটির দিন এবং প্রায় সাড়ে তিন মাস পরে চিঠিগুলি বিলি হল।
তিন এপ্রিল রবিবার হওয়ায় সমনপ্রাপ্তরা পর দিন সকাল দশটার মধ্যেই আদালতে হাজির হয়ে যান। আইনী কাজ তাঁদের পক্ষে এগিয়ে আসেন শহরের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী পীযুষ ঘোষ, শুভাঞ্জন সেনগুপ্ত, নীলাঞ্জন পাণ্ডে এবং অনুপবাবু। বারের সম্পাদক প্রিয়াঙ্কু দাস অক্টবরেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে বহরমপুর আদালতের আইনজীবীরা কমি্টির পাশে থাকবে। বিনা পারিশ্রমিকে উল্লিখিত আইনজীবীরা আইনী কাগজ তৈরি করে দেন এবং বিচারকের সামনে হাজির হয়ে ব্যক্তিগত জামিননা্মার ভিত্তিতে জামিন দেওয়ার আর্জি পেশ করেন। সরকারের পক্ষ থেকে কোন আপত্তি ওঠেনি এবং বিচারক সুমনা গোড়াই আর্জি অনুমোদন করেন। শহরের আইনজীবীরা এমন আচরণ আগেও দেখিয়েছেন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে জমি দখল আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা গ্রেপ্তার হলে তাঁরা আদালতে বন্দিদের মুক্তির দাবিতে সওয়াল করেছিলেন, ১৯৭৫ সালে অনীক ও মুর্শিদাবাদ বীক্ষণ পত্রিকার সম্পা্দক দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে পুলিশ তাঁর এক রচনার জন্য গ্রেপ্তার করে আদালতে তুললে সরকারি আইনজীবী প্রয়াত বিজয় কুমার গুপ্ত আদালতে দাঁড়িয়েই শ্রী চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে মিসা(আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষ আইন) প্রয়োগ করা যায় না বলে সওয়াল করেছিলেন, ২০০০ সালের আগস্টে নদী ভাঙন ও বন্যা প্রতিরোধ কমি্টির ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য শহরের বহু বিশিষ্ট প্রবীণ ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলে প্রায় সমস্ত আইনজীবীই আন্দোলনকা্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, এমন কি তৎকালীন ‘প্রবল ক্ষমতাশালী’ পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্যও বহরমপুর থানায় গিয়েছিলেন।
জামিনে ছাড়া পেয়ে বাড়ি চলে না গিয়ে জলাভূমি রক্ষা কমি্টির সদস্যরা আদালতের কাছেই রাস্তায় পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে আওয়াজ দিয়েছেন জোরালো ও সমবেত কণ্ঠে যে পুলিশ দিয়ে, আদালতে টেনে এনেও তাঁদের আন্দোলনকে বন্ধ করা যাবে না, বরং তা আরও জোরদার হবে যদি জলাভূমি রক্ষার্থে প্রশাসন কার্যকরী ভূমিকা পালন না করে।